এনএনবি : বাংলাদেশকে নতুন করে সহযোগিতা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা এ অঞ্চলে কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উদ্বেগের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখছে।
মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রাজিলীয় সংবাদমাধ্যম দ্য রিও টাইমস।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সফরে গণতন্ত্রের ওপর জোর দেন। একইসঙ্গে অবাধ ভোটে প্রতিবন্ধকতার অভিযোগে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিল ওয়াশিংটন।
কিন্তু ভিসা বিধিনিষেধের হুমকি সত্ত্বেও বিরোধীদের নানা অভিযোগের মধ্যে অনুষ্ঠিত ভোটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয়েই এই নির্বাচনকে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নয়’ বলে সমালোচনা করেছে।
সবকিছু ছাপিয়ে সম্প্রতি ভিন্ন বার্তা নিয়ে তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন ডোনাল্ড লু। এবার তিনি বিরোধী নেতা এবং অধিকার-সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর সাথে বৈঠক এড়িয়ে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব এবং জলবায়ু উদ্যোগ জোরদার করার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। যা যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে – এই পরিবর্তন এমনটিই ইঙ্গিত দেয়।
ডোনাল্ড লু স্বীকার করেছেন, পূর্ববর্তী নির্বাচনি সতর্কতা যদিও উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছিল, তবে তিনি এখন ‘এগিয়ে যাওয়ার’ এবং ‘আস্থা পুনর্নির্মাণের’ প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখযোগ্য পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ ওয়াশিংটনের কাছে কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে। ভারত ও মিয়ানমারের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা এই দেশটিকে চীনের আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণে মূল্যবান মিত্র হিসেবে দেখা হয়।
অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের মাত্র এক মাস পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করার ‘আন্তরিক ইচ্ছা’ প্রকাশ করেন। তাদের লক্ষ্য একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিসহ বিভিন্ন ইস্যু মোকাবিলা করা।
গত পাঁচ দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের মতো অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও বহুজাতিক ইস্যুগুলোকে ঘিরে জটিল সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
একদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানির শীর্ষ গন্তব্য, যা ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে করোনা মহামারির সময়ে বাংলাদেশকে ৬ কোটি ১০ লাখের বেশি কোভিড-১৯ টিকা দিয়েছিল ওয়াশিংটন।
ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও ২০২১ সালটি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। সেই বছর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে ভার্চুয়াল সামিট ফর ডেমোক্রেসিতে (গণতন্ত্র সম্মেলন) বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি বাইডেন প্রশাসন। তারা ধারাবাহিকভাবে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ভারত ও চীনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা চায় ভারত। এর বিপরীতে চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো ও সামরিক খাতে বিনিয়োগ করে। তবে ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ তার মার্কিন সম্পর্ককে কাজে লাগায়।
তবে কোয়াডের মতো জোটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সহযোগিতা বাড়ানো এই ভারসাম্যকে জটিল করে তুলেছে।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের স্বার্থ
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড ঢাকা সফর করেন। তিনি একটি খসড়া প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিতে সই করেন।
একই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের অর্থায়নে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করেন। এই ঘটনা বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি তুলে ধরেছে।
অবকাঠামো উন্নয়নই বাংলাদেশের অগ্রাধিকার। চীন উল্লেখযোগ্য সমর্থন দিচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার, যা অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ব্যবসায়িক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, তারপরও তারা দুর্নীতি ও মানবাধিকার ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করে।
সম্প্রতি দুর্নীতির দায়ে বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই তুলে ধরেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বড় ধরনের কূটনৈতিক চাপ এড়িয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর প্রভাব বজায় রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে যোগাযোগ একটি কৌশলগত পুনর্বিবেচনার প্রতিফলন। এই দৃষ্টিভঙ্গি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগের সাথে তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখে।